Author: avia nahreen

Area of Work: Regional Cooperation Integration

এখন এক অনিবার্য প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ কেন ৪৭তম অর্থনীতির দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ করছে? গত বছরের অক্টোবরে চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফরটি ‘ঐতিহাসিক রাষ্ট্রীয় সফর’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এটি দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগর অঞ্চলের খেলা বদলে দিয়েছে। এই সফরের অংশ হিসেবে চীনা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোর ১ হাজার ৩৬০ কোটি ডলারের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ চুক্তি হয়েছে। এর বাইরে দুই দেশের সরকারের মধ্যে ২ হাজার কোটি ডলারের চুক্তি হয়েছে। বাংলাদেশের কী এমন ভূ-কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে, যার কারণে তারা পৃথিবীর মাতবর হতে প্রত্যাশী দেশের কাছ থেকে এত বড় সহায়তা পেতে পারে। ব্যাপারটা হচ্ছে—কৌশলগতভাবে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান, ভারতের সঙ্গে তার ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক নৈকট্য, সস্তা শ্রমের প্রাপ্যতা এবং বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি অবস্থান—এসব কিছুই চীনের আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি ও ভূ-অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

চীনা অর্থনীতি অনেকাংশে ভারত মহাসাগর দিয়ে আনা জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। চীন মধ্যপ্রাচ্য থেকে যে পরিমাণ জ্বালানি আমদানি করে থাকে, তার ৮০ শতাংশই আসে মালাক্কা প্রণালি দিয়ে; এই সরু অংশটি ভারত মহাসাগরের সঙ্গে প্রশান্ত মহাসাগরের সংযোগ স্থাপন করেছে। এই মালাক্কা প্রণালি দিয়েই ইউরোপ, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে চীন দ্রুততম সময়ের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারে। চীনের জ্বালানি চাহিদা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। ফলে তার কাছে এ অঞ্চলটির গুরুত্ব ক্রমেই বাড়ছে। এই অঞ্চলে প্রভাব বাড়ানোর পাশাপাশি এর ওপর অতি নির্ভরশীলতা কমাতে চীন ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোকে বিনিয়োগ প্রস্তাব দিচ্ছে। এ কারণেই বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে এই বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়েছে। আবার বহুল কথিত স্ট্রিং অব পার্ল তত্ত্বের জন্যও বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছে।

মালাক্কা প্রণালির ওপর অধিক নির্ভরশীলতা কমাতে চীন ইতিমধ্যে িময়ানমারের কিয়াকপিউ বন্দর থেকে কুনমিং পর্যন্ত পাইপলাইন নির্মাণ করছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে চীন বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর উন্নয়নেও আগ্রহী। এতে করে সে চট্টগ্রাম-কিয়াকপিউ-কুনমিং পাইপলাইন নির্মাণ করতে পারবে। ভারত যদি কখনো মার্কিন সহায়তায় আন্দামান সাগরে মালাক্কা চেকপয়েন্ট বন্ধ করে দিতে পারে, তাহলে চীনা উৎপাদন খাতের ওপর এর গুরুতর প্রভাব পড়বে। তাই চীন এসব কাজ করছে।

বহুদিন ধরে চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। এবার তারা দক্ষিণ এশিয়াতে নজর দিয়েছে। উল্লেখ্য, এই অঞ্চলে বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ মানুষের বসবাস; আর ক্রয়ক্ষমতার সামর্থ্যের ভিত্তিতে এই অঞ্চল বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। ফলে চীনা পণ্যের জন্য এটি আকর্ষণীয় এক বাজার। বিতর্কিত অরুণাচল প্রদেশ, আফগানিস্তান বা পাকিস্তান হয়ে ভারতে ঢোকা যেহেতু বাস্তবসম্মত নয়, তাই বাংলাদেশ হয়ে তার ভারতে ঢোকা সম্ভব। বাংলাদেশের সঙ্গে তার সে সম্পর্কও আছে। আর বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমারের সমন্বয়ে গঠিত উপ-আঞ্চলিক করিডর দক্ষিণ এশিয়ায় চীনা পণ্য ঢোকার জন্য সহায়ক হওয়ায় বাংলাদেশকে আস্থায় নেওয়া চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অবকাঠামো খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করে চীন বাংলাদেশকে কাছে টানতে চায়, বিশেষজ্ঞরা একে ‘চেকবুক কূটনীতি’ আখ্যা দিয়েছেন।

চীন ভারতের আঞ্চলিক প্রভাব কমাতে তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে অস্ত্র বিক্রি করে নীরবে তাকে আটকে দিচ্ছে। বেইজিং এখন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী, ২০১১-১৫ কালপর্বে সে ৭১ শতাংশ অস্ত্র বিক্রি করেছে পাকিস্তান, মিয়ানমার ও বাংলাদেশে। এ সময়কালে ঢাকা তার ৮০ শতাংশ অস্ত্রই বেইজিংয়ের কাছ থেকে কিনেছে। কারও কাছে ভারী অস্ত্র বিক্রি করা মানে প্রশিক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতে রপ্তানিকারক দেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া। এতে আমদানিকারক দেশটির ওপর যথেষ্ট প্রভাব পড়ে। চীন সহজ অর্থায়ন ও কম দামে ভারতের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে অস্ত্র বিক্রি করে ভারতকে নজরে রাখছে। বাংলাদেশে অস্ত্র বিক্রি থেকে যেমন রাজস্ব পাওয়া যাবে, তেমনি এ অঞ্চলে ভারতের প্রভাবও সামাল দেওয়া যাবে।

১৯৬০-এর দশকে চীন আঞ্চলিক সহযোগিতামূলক জোটে যেতে না চাইলেও সি চিন পিংয়ের নেতৃত্বে পরিস্থিতি বদলে যায়। চীন এখন এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড (ওবোর)’ প্রকল্পের মতো বড় কাজ হাতে নিচ্ছে। একুশ শতকের সিল্ক রোডে চট্টগ্রাম বন্দরও গুরুত্বপূর্ণ, যার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও সমুদ্রপথ–বিষয়ক উদ্যোগের লক্ষ্য বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। এখন পর্যন্ত এই ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্পই সি চিন পিংয়ের সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী ও অর্থনৈতিক নীতি। নিজের দ্বিতীয় জমানাকে শক্তিশালীকরণ, ধীরলয়ের চীনা অর্থনীতিকে চাঙা করা এবং প্রতিবেশী দেশের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর জন্য তিনি ইতিমধ্যে জোরেশোরে এ প্রকল্পের প্রচারণা শুরু করেছেন। ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্প চীনকে এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মুক্তবাণিজ্যের নতুন নেতা হতে সাহায্য করবে। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে টিপিপি থেকে সরিয়ে আনতেও এটি সহায়ক হবে। এ ছাড়া এটি ভূ-অর্থনৈতিকভাবে চীনকে তার অত্যধিক সামর্থ্য কাজে লাগাতেও সহায়তা করবে। ওবোরের মধ্যকার সব আন্তসম্পর্ক বাস্তবায়ন করতে সি চিন পিংকে এখন ভারতের সব সাবেক দক্ষিণ এশীয় সহযোগীর সহমর্মিতা লাভ করতে হবে।

চীনে শ্রমের মজুরি বাড়তে থাকায় তার পতনশীল শিল্পকে নতুন জায়গা খুঁজতে হবে। এ কারণে চীনকে এখন শ্রমঘন নিম্ন প্রযুক্তির শিল্প থেকে সরে আসতে হবে। তাকে এখন উচ্চ মুনাফা ও প্রযুক্তির পণ্য যেমন আইটি, অ্যারোস্পেস ও টেলিযোগাযোগ খাতে নজর দিতে হবে। বাংলাদেশে ১৫-৩০ বছর বয়সী তরুণের সংখ্যা বিপুল। অর্থাৎ সেখানে এখন বিপুলসংখ্যক সস্তা শ্রমিক পাওয়া যাবে। চীনের শ্রমঘন শিল্পের মালিকেরা—যাঁরা উৎপাদন চালিয়ে যেতে চান, তাঁদের জন্য বাংলাদেশ শিল্প স্থানান্তরের ভালো জায়গা হতে পারে।

এসব কারণেই সি চিন পিং বাংলাদেশ সফরের সময় বলেন, বাংলাদেশ-চীনের সম্পর্ক এখন ‘কৌশলগত অংশীদারি ও সহযোগিতায়’ উন্নীত হয়েছে, যেটা আগে ছিল ‘সমন্বিত অংশীদারি’। বাংলাদেশকে এখন সূক্ষ্ম ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় রেখে চীনের চেকবুক কূটনীতি থেকে লাভবান হতে হবে।

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, এশিয়ানিউজ ডট নেটওয়ার্ক থেকে নেওয়া।

আভিয়া নাহরিন: বাংলাদেশের ইনস্টিটিউট ফর পলিসি, অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্সের সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট।

Weblink:http://www.prothom-alo.com/opinion/article/1154386/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%9A%E0%A7%80%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%9F%E0%A7%8B%E0%A6%9C%E0%A6%A8

Write a Reply or Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


*